বায়ুমণ্ডল: সৃষ্টি, গঠন এবং বৈশিষ্ট্য
আমাদের পৃথিবীকে ঘিরে রয়েছে এক বিস্ময়কর স্তর, যেটিকে আমরা বায়ুমণ্ডল বলি। প্রতিদিন আমরা যে বাতাসে নিঃশ্বাস নেই, যে আবহাওয়ার পরিবর্তন দেখি, বৃষ্টি, ঝড়, বা রোদ—এসব কিছুই এই বায়ুমণ্ডলের অন্তর্গত। তবে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে: এই বায়ুমণ্ডল তৈরি হলো কীভাবে? পৃথিবী যখন সৃষ্টি হয়েছিল, তখন কি এর চারপাশে এমন কোনো গ্যাসীয় স্তর ছিল? না থাকলে পরে কীভাবে এটা গঠিত হলো? আসুন ধাপে ধাপে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি।
বায়ুমণ্ডলের সৃষ্টি কীভাবে হলো?
পৃথিবী যখন সৃষ্টি হয়, তখন সেটি ছিল একটি উত্তপ্ত, আগ্নেয়গিরিময় গ্রহ। এর পৃষ্ঠ তখন এতটাই উত্তপ্ত ছিল যে সেখানে কোনো গ্যাস স্থায়ী হতে পারত না। কিন্তু ধীরে ধীরে, পৃথিবীর তাপমাত্রা কমতে শুরু করে। এই সময় নানা রকম গ্যাস, যেমন—জলীয় বাষ্প, কার্বন ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন ইত্যাদি, পৃথিবীর অভ্যন্তর থেকে নির্গত হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
এগুলো প্রথমে চারদিকে ছড়িয়ে ছিল, কিন্তু পরে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি (gravity) তাদের ধরে রাখে। এই শক্তি না থাকলে কোনো গ্যাসই পৃথিবীর চারপাশে টিকে থাকতে পারত না। ধরুন, যদি পৃথিবীর কোনো অভিকর্ষণ বা কেন্দ্রাতিগ বল না থাকত, তাহলে গ্যাসগুলো কোথাও স্থির থাকত না, ছড়িয়ে পড়ত মহাকাশে। ফলে বায়ুমণ্ডল কখনও গঠিতই হতো না।
সুতরাং বলা যায়, বায়ুমণ্ডল গঠনের পেছনে মূল চালিকাশক্তি ছিল পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ। এই শক্তিই গ্যাসগুলোকে পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি আটকে রাখে এবং একটি নির্দিষ্ট স্তর বা আবরণ তৈরি করে, যেটিই বায়ুমণ্ডল নামে পরিচিত।
গ্যাসগুলো থাকে কীভাবে?
আমরা জানি, যে পদার্থ যত ভারী, তা তত নিচে থাকতে চায়। একই নিয়ম গ্যাসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই পৃথিবীর পৃষ্ঠের কাছাকাছি অংশে আমরা বেশি ঘন গ্যাস পাই এবং ওপরের দিকে গেলে গ্যাস হালকা হয়ে যায়, পাতলা হয়ে যায়।
এই কারণেই নিচের স্তরে নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনের ঘনত্ব বেশি, আর ওপরের দিকে গিয়ে তা হ্রাস পেতে থাকে। আর এই কারণেই আমাদের দেহ নিচু জায়গায় ভালোভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারে, কিন্তু পাহাড় বা উঁচু স্থানে গেলে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়—কারণ সেখানকার বাতাস হালকা এবং অক্সিজেন কম।
বায়ুমণ্ডল তৈরির মূলে ছিল অপকর্ষতরণ (Outgassing)
বায়ুমণ্ডলের সৃষ্টি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটেছে, যেটাকে বলে অপকর্ষতরণ। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে পৃথিবীর অভ্যন্তর থেকে গ্যাস নির্গত হয়ে আস্তে আস্তে বাইরে বেরিয়ে আসে। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, গরম লাভা থেকে উঠে আসা গ্যাস এসবই এই প্রক্রিয়ার অংশ।
এই অপকর্ষতরণ থেকেই পৃথিবীর চারপাশে গ্যাস জমা হতে থাকে, এবং ধীরে ধীরে গঠন হয় আজকের এই বায়ুমণ্ডল।
বায়ুমণ্ডলের উপাদানসমূহ
বায়ুমণ্ডল কেবল এক ধরনের গ্যাস দিয়ে তৈরি নয়, বরং এটি একটি মিশ্রণ। নিচে বায়ুমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো শতাংশ অনুযায়ী উল্লেখ করা হলো:
উপাদান শতকরা হার (%)
নাইট্রোজেন ৭৮.০২%
অক্সিজেন ২০.৭১%
আর্গন ০.৮%
কার্বন ডাইঅক্সাইড ০.০৩%
জলীয় বাষ্প ০.৪১% (ভ্যারিয়েবল)
ধুলিকণা ও কণিকা ০.০১%
এই উপাদানগুলো সবই আমাদের পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যেমন:
নাইট্রোজেন গাছের জন্য অত্যাবশ্যকীয় একটি পুষ্টি উপাদান।
অক্সিজেন ছাড়া আমরা বা অন্য প্রাণীরা বাঁচতে পারি না।
কার্বন ডাইঅক্সাইড উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয়, কারণ তারা এই গ্যাস শোষণ করে ফটোসিনথেসিস করে।
জলীয় বাষ্প আবহাওয়ার পরিবর্তনে প্রধান ভূমিকা পালন করে।
এছাড়াও বায়ুমণ্ডলে থাকে ধুলিকণা ও কণিকা, যা মেঘ গঠনের প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে।
বায়ুর সহজ বৈশিষ্ট্য: উষ্ণতা ও ঘনত্ব
বায়ু গরম হলে কী হয়? এটাই এখন আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। বায়ুর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো: তাপমাত্রা বাড়লে বায়ু প্রসারিত হয়, আর কমলে সংকুচিত হয়।
যখন বায়ু গরম হয়, তখন তার ভলিউম বেড়ে যায়। সে প্রসারিত হয়ে হালকা হয়ে যায় এবং ওপরে উঠে যায়।
আবার যখন বায়ু ঠান্ডা হয়, তখন তা সংকুচিত হয়, ভারী হয় এবং নিচে নেমে আসে।
এই বৈশিষ্ট্যই আসলে পৃথিবীর আবহাওয়ার পেছনে মূল কাজ করে। গরম বায়ু উপরে উঠে, ঠান্ডা বায়ু নিচে নামে—এর মাধ্যমেই তৈরি হয় বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত এবং অন্যান্য আবহাওয়াজনিত পরিবর্তন।
একটি সহজ উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে:
ধরুন একটি বেলুনে আপনি গরম বাতাস ঢোকালেন। এটি হালকা হয়ে উপরে উঠে যাবে। কারণ গরম বায়ুর ভর কম, তাই এটি ওপরে ওঠে। আবার ঠান্ডা বাতাস বেশি ঘনত্ব সম্পন্ন, তাই নিচে থাকে।
জলীয় বাষ্প সম্পর্কে বিশেষ তথ্য
জলীয় বাষ্প বায়ুমণ্ডলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। এটি আসলে পানির গ্যাসীয় রূপ। এটি নানা ভাবে আমাদের পরিবেশে ভূমিকা রাখে:
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে
মেঘ, কুয়াশা, বৃষ্টি প্রভৃতি আবহাওয়াজনিত পরিবর্তনে অংশ নেয়
বায়ুমণ্ডলের নিচের স্তরে বেশি পাওয়া যায়
বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে, শুষ্ক বায়ুতে জলীয় বাষ্প বেশি পরিমাণে থাকতে পারে, কারণ সেখানে অনুপাত অনুযায়ী অন্যান্য গ্যাস কম থাকে।
শেষ কথা
বায়ুমণ্ডল আমাদের পৃথিবীর জীবনধারার জন্য অপরিহার্য। এটি শুধুই গ্যাসের মিশ্রণ নয়, বরং একেকটি উপাদান জীবনের বিভিন্ন দিকের সঙ্গে জড়িত। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ না থাকলে এই বায়ুমণ্ডলও টিকে থাকত না। আবার তাপমাত্রা ও ঘনত্বের তারতম্য না থাকলে আবহাওয়াও গঠিত হতো না।
তাই শুধু মুখস্থ নয়, বায়ুমণ্ডলের প্রতিটি বৈশিষ্ট্য, উপাদান ও তার কাজগুলো বুঝে শেখা জরুরি। পরীক্ষার জন্য যেমন এই তথ্যগুলো গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আমাদের জীবন ও পরিবেশ বুঝতেও এসব জানা দরকার।
0コメント